আহমদ গিয়াস:
বাংলাদেশের সাথে যুদ্ধে জড়ালে মিয়ানমারের অন্তত ৩টি রাজ্য দ্রুত স্বাধীন হয়ে যাবে। এরমধ্যে কাচিন, শান ও রাখাইন (আরাকান) অন্যতম।
মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বশাসন ও স্বাধীনতার দাবিতে লড়াইরত অন্তত ২১টি নৃতাত্তিক সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে মাত্র ৮টি গ্রুপ সম্প্রতি সরকারের সাথে অস্ত্রবিরতি চুক্তিতে এলেও বাকী বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর সাথে প্রায়ই লড়াই হচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর। এমনকি এসব সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপগুলো সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য নিজেদের মধ্যেও ঐক্য গড়ে তুলেছে। এরমধ্যে ৭টি সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপ মিয়ানমারের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য কাচিনের গহীন অরণ্যে বিশাল দূর্গ গড়ে তুলেছে। তারা সেখানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। প্রশিক্ষণ শেষে সরকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযানে অংশ নিচ্ছে তারা। এদের বাইরে উত্তর আরাকানে (রাখাইন) স্বতন্ত্রভাবে লড়াই করছে সাম্প্রতিককালের আলোচিত বাহিনী রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন আরসা। সাম্প্রতিককালে মিয়ানমারজুড়ে সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের অভ্যন্তরে নতুন করে চাপের মুখে পড়েছে সরকার। আর রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের চাপও দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মিয়ানমারের গণমাধ্যম সূত্র মতে, গত বছরের ২৫ আগস্টের পর থেকে পাঁচ মাসে আরসা বড় কোন সফল হামলা চালাতে সক্ষম না হলেও অন্যান্য বিদ্রোহী সংগঠনগুলো প্রায় নিয়মিতভাবেই সরকারি বাহিনীর উপর ভয়াবহ হামলা চালাচ্ছে এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটাচ্ছে। গত ডিসেম্বর মাস ধরে অন্তত ৩টি রাজ্যে বিদ্রোহী বাহিনীর ভয়াবহ হামলা মোকাবেলা করছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং এতে বেশ কয়েকজন সেনা সদস্য হতাহত হওয়া ছাড়াও তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে এ বছরের শুরু থেকে মিয়ানমারের সরকারী বাহিনী সবচেয়ে বেশি প্রতিরোধের সম্মুখিন হচ্ছে আরাকান বা রাখাইনে। আরাকানের স্বাধীনতা হারানোর ২৩৪ বছর পূর্তি উপলক্ষে র‌্যালি করতে গিয়ে গত ৩১ ডিসেম্বর পুলিশের গুলীতে নিহত হয় ৭জন রাখাইন। আর এই হামলার প্রতিশোধ নিতে ওই একদিনেই ৫১৯ জন রাখাইন যুবক আরাকান আর্মিতে যোগ দেয় বলে একটি অসমর্থিত সূত্রে জানা গেছে। শুধু তাই নয়, গত মাসের শুরুতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন ভারত সীমান্তের কাছে আরাকান আর্মির একটি ক্যাম্পে হামলা চালাতে গিয়ে ব্যাপক নাস্তানাবুদের শিকার হয়। এসময় এক ভয়াবহ যুদ্ধে মিয়ানমার মিলিটারির প্রায় ৩শ সদস্য নিহত হয় বলে ওই সূত্রটি জানায়। অবশ্য নিরপেক্ষ কোন সূত্র থেকে তথ্যটি যাচাই করা যায়নি।
তবে মিয়ানমার গণমাধ্যমে আসা ছিটেফোঁটা তথ্য থেকে জানা যায়। আরাকান বা রাখাইনের রাজধানী আকিয়াব বা সিতওয়েতে সংসদ ভবনের নিকটবর্তী ৩টি স্থানে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি একযোগে বোমা হামলা চালানো হলে এতে কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হয়। এই ঘটনায় এই পর্যন্ত ৭জন মগ বা রাখাইনকে সন্দেহভাজন আসামী হিসাবে আটক করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে আরাকান ন্যাশনাল কাউন্সিলের (এএনসি) একজন শীর্ষস্থানীয় নেতাও রয়েছেন। এএনসির সশস্ত্র শাখার নাম আরাকান আর্মি।
মিয়ানমারের শক্তিশালী গণমাধ্যম ইরাওয়াদ্দির খবরে প্রকাশ, জানুয়ারি মাসের প্রথমদিন ও আগের মাসের (ডিসেম্বর) ১৬ তারিখ মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চীয় কাচিন রাজ্যে ডেমেক্রেটিক কাচিন বুড্ডিস্ট আর্মির (ডিকেবিএ) সাথে সেদেশের সেনাবাহিনীর দীর্ঘ সময় ধরে লড়াই হয়েছে। একই সময়ে এই রাজ্যের মানশি শহরতলীতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে লড়াই করতে হয়েছে কাচিন ইন্ডেপেন্ডেন্ট আর্মির (কেআইএ) সাথে। গত ২৭ ডিসেম্বর কিউকমি ও নামশান শহরতলীতে ‘টাআং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ)’ যোদ্ধাদের সাথে সেনাবাহিনীর কয়েক ঘন্টাব্যাপী যুদ্ধ হয়েছে। এতে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এসব এলাকায় এখনও তীব্র উত্তেজনা চলছে। পৃথকভাবে গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে সেনাবাহিনীকে মোকাবেলা করতে হয়েছে রাখাইন রাজ্যের রাখাইন সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির বেশ কয়েকটি শক্তিশালী হামলা। এই সংগঠনটি মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় ৭টি বিদ্রোহী সংগঠনের একটি এলায়েন্সের সদস্য।
মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, সাম্প্রতিককালে আরাকান আর্মি বেশ কয়েকটি সুসংগঠিত হামলা চালিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী টাডমাডোর উপর। নতুন করে আরো হামলার হুমকী দিয়েছে। রোহিঙ্গা বিতাড়নের পর সরকারী বাহিনী এখন সবচেয়ে বেশি হামলার শিকার হচ্ছে আরাকান আর্মির। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। গত কয়েক বছর আগে তারা বাংলাদেশ সীমান্তেও ঢুকে পড়ে এবং কয়েকজন বিজিবি সদস্যকে মারধর করে। এই ঘটনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়ে আরাকান আর্মির আস্তানা গুড়িয়ে দেয়। এই ঘটনার পর থেকে তারা বাংলাদেশ সরকারের উপর ক্ষিপ্ত। তাদের সাথে বাংলাদেশের বাহিনীর সম্পর্কও তিক্ততাপূর্ণ। তবে বাংলাদেশের সাথে যুদ্ধে জড়ালে মিয়ানমারকে চাপে ফেলতে সেদেশের বিদ্রোহী সংগঠনগুলোকে ব্যবহার করতে চেষ্টা করবে বাংলাদেশ। এদের সাথে নতুন করে সম্পর্ক তৈরীর চেষ্টা করবে। বাংলাদেশের সহযোগিতা পেলে মিয়ানমারের ৩টি রাজ্য স্বাধীন হয়ে যাওয়া বেশি দিনের বিষয় নয়।
এ কারণে মিয়ানমার হয়তো বাংলাদেশকে সরাসরি আক্রমণ করতে চাইবে না। তার পরিবর্তে চাইবে রোহিঙ্গা ঢলের মতো পরিস্থিতি তৈরি করে বাংলাদেশকে সংকটে রাখতে। পাশপাশি ইয়াবা পাচারসহ আরো নানা পথে নতুন নতুন সংকট তৈরী করতে। সুতরাং ছায়াযু্েদ্ধর সৈনিকও ছায়াই হওয়া ভাল!